সকলে যিহোবার গৌরব বর্ণনা করুক
সকলে যিহোবার গৌরব বর্ণনা করুক
“সদাপ্রভুর [“যিহোবার,” NW] গৌরব ও শক্তি কীর্ত্তন কর। সদাপ্রভুর [“যিহোবার,” NW] নামের গৌরব কীর্ত্তন কর।”—গীতসংহিতা ৯৬:৭, ৮.
১, ২. কোন উৎস থেকে যিহোবার প্রশংসা কীর্তন করা হয় এবং এতে যোগ দেওয়ার জন্য কাদের অনুরোধ করা হয়েছে?
যিশয়ের ছেলে, দায়ূদ বৈৎলেহমের একজন বালক মেষপালক হিসেবে বড় হয়ে উঠেছিলেন। মেষপালের সেই নির্জন চারণক্ষেত্রে বাবার পালগুলো দেখাশোনা করার সময় কতবারই না তিনি নিস্তব্ধ রাতের বিশাল তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন! কোনো সন্দেহ নেই যে, সেই প্রাণবন্ত অভিব্যক্তিগুলো তার মন থেকে উদয় হয়েছিল, যখন তিনি ঈশ্বরের পবিত্র আত্মার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯ গীতের এই চমৎকার কথাগুলো রচনা করেছিলেন এবং গেয়েছিলেন: “আকাশমণ্ডল ঈশ্বরের গৌরব বর্ণনা করে, বিতান তাঁহার হস্তকৃত কর্ম্ম জ্ঞাপন করে। তাহাদের মানরজ্জু সমস্ত পৃথিবীতে ব্যাপ্ত, তাহাদের বাক্য জগতের সীমা পর্য্যন্ত ব্যাপ্ত।”—গীতসংহিতা ১৯:১, ৪.
২ বাক্য, ভাষা এবং রব ছাড়াই যিহোবার বিস্ময়কর সৃষ্টি আকাশমণ্ডল দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তাঁর গৌরব বর্ণনা করে। সৃষ্টি ঈশ্বরের গৌরব বর্ণনা করতে কখনও ক্ষান্ত হয় না এবং এই নীরব সাক্ষ্যকে মনোযোগের সঙ্গে বিবেচনা করা নম্রতার কাজ, যা “সমস্ত পৃথিবীতে” বিস্তৃত যেন এর সকল নিবাসী দেখতে পায়। কিন্তু, সৃষ্টির নীরব সাক্ষ্যই কেবল যথেষ্ট নয়। বিশ্বস্ত মানুষদের শ্রবণসাধ্য স্বর নিয়ে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। নামহীন এক গীতরচক এই অনুপ্রাণিত কথাগুলোর মাধ্যমে বিশ্বস্ত উপাসকদের উদ্দেশে বলেছিলেন: “যিহোবার গৌরব ও শক্তি কীর্ত্তন কর। যিহোবার নামের গৌরব কীর্ত্তন কর।” (গীতসংহিতা ৯৬:৭, ৮) যিহোবার সঙ্গে যাদের নিকট সম্পর্ক রয়েছে, তারা সেই মিনতিতে সাড়া দিয়ে রোমাঞ্চিত হয়। কিন্তু, যিহোবার গৌরব কীর্তন করার সঙ্গে কী জড়িত?
৩. কেন মানুষেরা ঈশ্বরের গৌরব কীর্তন করে?
৩ শুধু কথায় বলার চেয়ে আরও বেশি কিছুর প্রয়োজন। যিশাইয়ের দিনের ইস্রায়েলীয়রা তাদের ওষ্ঠাধরে ঈশ্বরকে গৌরবান্বিত করেছিল কিন্তু অধিকাংশেরই আন্তরিকতার অভাব ছিল। যিশাইয়ের মাধ্যমে যিহোবা বলেছিলেন: “এই লোকেরা আমার নিকটবর্ত্তী হয়, এবং আপন আপন মুখে ও ওষ্ঠাধরে আমার সম্মান করে, কিন্তু আপন আপন অন্তঃকরণ আমা হইতে দূরে রাখিয়াছে।” (যিশাইয় ২৯:১৩) এই ধরনের ব্যক্তিরা যে-প্রশংসাই করুক না কেন, তা অর্থহীন ছিল। অর্থপূর্ণ হতে হলে, প্রশংসা যিহোবার প্রতি ভালবাসায় পূর্ণ হৃদয় থেকে এবং তাঁর অদ্বিতীয় গৌরব সম্বন্ধে অকপট স্বীকারের মাধ্যমে আসতে হবে। যিহোবাই হলেন একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। তিনি হলেন সর্বশক্তিমান, সর্বোচ্চ ন্যায়পরায়ণ এবং প্রেমের মূর্ত প্রতীক। তিনিই আমাদের পরিত্রাণ এবং ন্যায্য সার্বভৌমের উৎস, যাঁর প্রতি স্বর্গ ও পৃথিবীর জীবিত সকলে বশীভূত হতে বাধ্য। (প্রকাশিত বাক্য ৪:১১; ১৯:১) আমরা যদি সত্যিই এই বিষয়গুলো বিশ্বাস করি, তা হলে আসুন আমাদের সমস্ত হৃদয় দিয়ে তাঁকে গৌরবান্বিত করি।
৪. কীভাবে ঈশ্বরের গৌরব করা যায়, সেই বিষয়ে যিশু কোন নির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন এবং আমরা কীভাবে সেগুলো পরিপূর্ণ করতে পারি?
৪ যিশু খ্রিস্ট আমাদের বলেছেন যে, কীভাবে ঈশ্বরের গৌরব করা যায়। তিনি বলেছিলেন: “ইহাতেই আমার পিতা মহিমান্বিত হন যে, তোমরা প্রচুর ফলে ফলবান্ হও; আর তোমরা আমার শিষ্য হইবে।” (যোহন ১৫:৮) কীভাবে আমরা প্রচুর ফলে ফলবান হই? প্রথমত, সর্বান্তঃকরণে “রাজ্যের . . . সুসমাচার” প্রচারে অংশ নিয়ে এবং এভাবে সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর সঙ্গে ঈশ্বরের “অদৃশ্য গুণ” সম্বন্ধে ‘জ্ঞাত’ করায় যোগ দিয়ে। (মথি ২৪:১৪; রোমীয় ১:২০) এ ছাড়া, এভাবে আমরা সকলে—প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে—সেই সমস্ত নতুন শিষ্য তৈরিতে অংশ নিই, যারা যিহোবা ঈশ্বরের উদ্দেশে প্রশংসার সমবেত সংগীতকে প্রসারিত করে। দ্বিতীয়ত, আমরা আমাদের মধ্যে পবিত্র আত্মার দ্বারা উৎপাদিত ফলসমূহ বৃদ্ধি করি এবং যিহোবা ঈশ্বরের সর্বোৎকৃষ্ট গুণগুলো অনুকরণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করি। (গালাতীয় ৫:২২, ২৩; ইফিষীয় ৫:১; কলসীয় ৩:১০) এর ফলে আমাদের রোজকার আচরণ ঈশ্বরকে গৌরবান্বিত করে।
“সমস্ত পৃথিবীতে”
৫. ব্যাখ্যা করুন যে, পৌল কীভাবে অন্যদের কাছে নিজেদের বিশ্বাস সম্বন্ধে বলে ঈশ্বরের গৌরব করার যে-দায়িত্ব খ্রিস্টানদের রয়েছে, সেই বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন।
৫ রোমীয়দের প্রতি লেখা চিঠিতে পৌল অন্যদের কাছে নিজেদের বিশ্বাস সম্বন্ধে বলার মাধ্যমে ঈশ্বরের গৌরব করার যে-দায়িত্ব খ্রিস্টানদের রয়েছে, সেই বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। রোমীয় পুস্তকের একটা প্রধান বার্তা হল, একমাত্র যারা যিশু খ্রিস্টতে বিশ্বাস অনুশীলন করে, তারা রক্ষা পেতে পারে। তার চিঠির ১০ অধ্যায়ে পৌল দেখিয়েছিলেন যে, তার দিনের সাধারণ ইস্রায়েল তখনও মোশির ব্যবস্থা পালন করার মাধ্যমে এক ধার্মিক মান অর্জন করার চেষ্টা করছিল, যেখানে কিনা “খ্রীষ্টই ব্যবস্থার পরিণাম [ছিলেন]।” তাই পৌল বলেন: “তুমি যদি ‘মুখে’ যীশুকে প্রভু বলিয়া স্বীকার কর, এবং ‘হৃদয়ে’ বিশ্বাস কর যে, ঈশ্বর তাঁহাকে মৃতগণের মধ্য হইতে উত্থাপন করিয়াছেন, তবে পরিত্রাণ পাইবে।” সেই সময়ের পর থেকে, “যিহূদী ও গ্রীকে কিছুই প্রভেদ [হয়নি]; কেননা সকলেরই একমাত্র প্রভু; যত লোক তাঁহাকে ডাকে, সেই সকলের পক্ষে তিনি ধনবান্। কারণ ‘যে কেহ প্রভুর [“যিহোবার,” NW] নামে ডাকে, সে পরিত্রাণ পাইবে।’”—রোমীয় ১০:৪, ৯-১৩.
৬. পৌল কীভাবে গীতসংহিতা ১৯:৪ পদ প্রয়োগ করেছিলেন?
৬ এরপর পৌল যুক্তিযুক্তভাবে জিজ্ঞেস করেন: “তাহারা যাঁহাতে বিশ্বাস করে নাই, কেমন করিয়া তাঁহাকে ডাকিবে? আর যাঁহার কথা শুনে নাই, কেমন করিয়া তাঁহাতে বিশ্বাস করিবে? আর প্রচারক না থাকিলে কেমন করিয়া শুনিবে?” (রোমীয় ১০:১৪, ১৫) ইস্রায়েলের বিষয়ে পৌল বলেন: “সকলে সুসমাচারের আজ্ঞাবহ হয় নাই।” কেন ইস্রায়েল আজ্ঞাবহ হয়নি? সুযোগের অভাবের জন্য নয় বরং তাদের বিশ্বাসের অভাবের কারণে তারা সাড়া দেয়নি। পৌল এটা গীতসংহিতা ১৯:৪ পদ উদ্ধৃতি করে এবং সেটাকে সৃষ্টির নীরব সাক্ষ্যের পরিবর্তে খ্রিস্টীয় প্রচার কাজের ওপর প্রয়োগ করে তা দেখান। তিনি বলেন: “তাহাদের স্বর ব্যাপ্ত হইল সমস্ত পৃথিবীতে, তাহাদের বাক্য জগতের সীমা পর্য্যন্ত।” (রোমীয় ১০:১৬, ১৮) হ্যাঁ, এমনকি জড় সৃষ্টি যেমন যিহোবাকে গৌরবান্বিত করে, তেমনই প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টানরা সমস্ত জায়গায় পরিত্রাণের বার্তা প্রচার করেছিল আর এভাবে “সমস্ত পৃথিবীতে” ঈশ্বরের প্রশংসা করেছিল। কলসীয়দের প্রতি লেখা চিঠিতে পৌল এও বর্ণনা করেছিলেন যে, কতটা ব্যাপকভাবে সুসমাচার ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি বলেছিলেন যে, “আকাশমণ্ডলের অধঃস্থিত সমস্ত সৃষ্টির কাছে” সুসমাচার প্রচারিত হয়েছে।—কলসীয় ১:২৩.
উদ্যোগী সাক্ষিরা
৭. যিশুর কথা অনুসারে, খ্রিস্টানদের কোন দায়িত্ব রয়েছে?
৭ পৌল সম্ভবত, যিশু খ্রিস্টের মৃত্যুর প্রায় ২৭ বছর পর কলসীয়দের প্রতি তার চিঠিটা লিখেছিলেন। অপেক্ষাকৃত এত স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রচার কাজ কীভাবে কলসী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল? এটা হয়েছিল কারণ প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টানরা উদ্যোগী ছিল এবং যিহোবা তাদের উদ্যোগকে আশীর্বাদ করেছিলেন। যিশু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তাঁর অনুসারীরা সক্রিয় প্রচারক হবে, যখন তিনি বলেছিলেন: “অগ্রে সর্ব্বজাতির কাছে সুসমাচার প্রচারিত হওয়া আবশ্যক।” (মার্ক ১৩:১০) সেই ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে যিশু মথির সুসমাচারের শেষ পদগুলোর মধ্যে লিপিবদ্ধ এই আদেশটা যুক্ত করেছিলেন: “অতএব তোমরা গিয়া সমুদয় জাতিকে শিষ্য কর; পিতার ও পুত্ত্রের ও পবিত্র আত্মার নামে তাহাদিগকে বাপ্তাইজ কর; আমি তোমাদিগকে যাহা যাহা আজ্ঞা করিয়াছি সে সমস্ত পালন করিতে তাহাদিগকে শিক্ষা দেও।” (মথি ২৮:১৯, ২০) যিশু স্বর্গে যাওয়ার কিছু পরেই তাঁর অনুসারীরা ওই কথাগুলো পরিপূর্ণ করতে শুরু করেছিল।
৮, ৯. প্রেরিত পুস্তক অনুসারে, খ্রিস্টানরা যিশুর আদেশের প্রতি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল?
৮ সাধারণ কাল ৩৩ সালের পঞ্চাশত্তমীর দিনে পবিত্র আত্মা বর্ষিত হওয়ার পর, যিশুর অনুগত অনুসারীরা প্রথম যে-কাজটা করেছিল, সেটা হল বাইরে গিয়ে প্রচার করা এবং যিরূশালেমের লোকেদের “ঈশ্বরের মহৎ মহৎ কর্ম্মের কথা” বলা। তাদের প্রচার কাজ অনেক কার্যকরী ছিল এবং “কমবেশ তিন হাজার লোক” বাপ্তাইজিত হয়েছিল। এই শিষ্যরা জনসাধারণ্যে এবং উদ্যোগের সঙ্গে ঈশ্বরের প্রশংসা করে চলেছিল এবং তা উত্তম ফল নিয়ে এসেছিল।—প্রেরিত ২:৪, ১১, ৪১, ৪৬, ৪৭.
৯ সেই খ্রিস্টানদের কাজকর্ম শীঘ্রই ধর্মীয় নেতাদের নজরে পড়েছিল। পিতর এবং যোহন খোলাখুলিভাবে কথা বলায় বিক্ষুব্ধ হয়ে তারা এই দুই প্রেরিতকে প্রচার বন্ধ করার আদেশ দিয়েছিল। প্রেরিতরা উত্তর দিয়েছিল: “আমরা যাহা দেখিয়াছি ও শুনিয়াছি, তাহা না বলিয়া থাকিতে পারি না।” ভয় দেখানোর এবং ছেড়ে দেওয়ার পর, পিতর এবং যোহন তাদের ভাইদের কাছে ফিরে গিয়েছিল এবং সকলে যিহোবার প্রতি প্রার্থনায় যোগ দিয়েছিল। তারা সাহসের সঙ্গে যিহোবার কাছে যাচ্ঞা করেছিল: “তোমার এই দাসদিগকে সম্পূর্ণ সাহসের সহিত তোমার বাক্য বলিবার ক্ষমতা দেও।”—প্রেরিত ৪:১৩, ২০, ২৯.
১০. কোন বিরোধিতা প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল এবং সত্য খ্রিস্টানরা এর প্রতি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল?
১০ সেই প্রার্থনা যিহোবার ইচ্ছার সঙ্গে মিল রেখে ছিল, যা অল্প কিছু পরেই স্পষ্ট হয়েছিল। প্রেরিতদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং এরপর একজন দূতের দ্বারা তারা অলৌকিকভাবে মুক্ত হয়েছিল। দূত তাদেরকে বলেছিলেন: “তোমরা যাও, ধর্ম্মধামে দাঁড়াইয়া লোকদিগকে এই জীবনের সমস্ত কথা বল।” (প্রেরিত ৫:১৮-২০) প্রেরিতরা আজ্ঞা পালন করেছিল বলে যিহোবা তাদের আশীর্বাদ করে চলেছিলেন। তাই “তাঁহারা প্রতিদিন ধর্ম্মধামে ও বাটীতে উপদেশ দিতেন, এবং যীশুই যে খ্রীষ্ট, এই সুসমাচার প্রচার করিতেন, ক্ষান্ত হইতেন না।” (প্রেরিত ৫:৪২) স্পষ্টতই, প্রচণ্ড বিরোধিতা যিশুর অনুসারীদের জনসাধারণ্যে ঈশ্বরের গৌরব কীর্তন করা থেকে বিরত রাখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল।
১১. প্রচার কাজের প্রতি প্রাথমিক খ্রিস্টানদের মনোভাব কেমন ছিল?
১১ শীঘ্রই স্তিফানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং পাথর মেরে হত্যা করা হয়েছিল। তার হত্যা যিরূশালেমের ওপর প্রচণ্ড তাড়না নিয়ে এসেছিল এবং প্রেরিতরা ছাড়া সমস্ত শিষ্য দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। তারা কি তাড়নার কারণে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছিল? কখনোই না। আমরা পড়ি: “যাহারা ছিন্নভিন্ন হইয়াছিল, তাহারা চারদিকে ভ্রমণ করিয়া সুসমাচারের বাক্য প্রচার করিল।” (প্রেরিত ৮:১, ৪) ঈশ্বরের গৌরব বর্ণনা করার জন্য সেই উদ্যোগ বার বার দেখা গিয়েছিল। প্রেরিত ৯ অধ্যায়ে আমরা পড়ি যে, তার্ষের ফরীশী শৌল দম্মেশকে যিশুর শিষ্যদের তাড়না করার জন্য সেখানে যাওয়ার পথে যিশুর এক দর্শন পান এবং অন্ধ হয়ে যান। দম্মেশকে অননিয় অলৌকিকভাবে শৌলের অন্ধত্ব আরোগ্য করেন। শৌল—পরবর্তী সময়ে পৌল হিসেবে পরিচিত—প্রথমে যে-বিষয়টা করেছিলেন, সেটা কী ছিল? বিবরণ বলে: তিনি “অমনি সমাজ-গৃহে সমাজ-গৃহে যীশুকে এই বলিয়া প্রচার করিতে লাগিলেন যে, তিনিই ঈশ্বরের পুত্ত্র।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)—প্রেরিত ৯:২০.
সকলে প্রচার কাজে অংশ নিয়েছিল
১২, ১৩. (ক) ইতিহাসবেত্তাদের মতানুসারে প্রাথমিক খ্রিস্টান মণ্ডলী সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য বিষয়টা কী ছিল? (খ) প্রেরিত পুস্তক কীভাবে ইতিহাসবেত্তাদের উক্তিগুলোর সঙ্গে একমত?
১২ এটা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে, প্রাথমিক খ্রিস্টান মণ্ডলীর সকলে প্রচার কাছে অংশ নিত। সেই সময়ের খ্রিস্টানদের বিষয়ে ফিলিপ শেফ লেখেন: “প্রত্যেক মণ্ডলী এক মিশনারি সমাজ ছিল এবং প্রত্যেক বিশ্বাসী খ্রিস্টান একজন মিশনারি ছিলেন।” (খ্রিস্টীয় গির্জার ইতিহাস, ইংরেজি) ডব্লু. এস. উইলিয়ামস্ বলেন: “সাধারণ সাক্ষ্যপ্রমাণ হল যে, প্রাথমিক গির্জার সমস্ত খ্রিস্টান, বিশেষ করে যাদের অসাধারণ দান [আত্মার দান] ছিল, তারা সুসমাচার প্রচার করত।” (সাধারণ লোকেদের গৌরবান্বিত পরিচর্যা, ইংরেজি) তিনি জোরের সঙ্গে আরও বলেন: “যিশু খ্রিস্ট কখনও প্রচার করাকে পরিচর্যার কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীদের একমাত্র অধিকার বলে উল্লেখ করেননি।” এমনকি খ্রিস্টধর্মের একজন প্রাচীন বিরোধী সেলসাস লেখেন: “পশম কর্মী, মুচি, চর্ম পরিষ্কারক, একেবারে নিরক্ষর এবং অশিক্ষিত মানুষেরা সুসমাচারের উদ্যোগী প্রচারক ছিল।”
১৩ ওই উক্তিগুলোর সত্যতা প্রেরিত পুস্তকের ঐতিহাসিক বিবরণে দেখা যায়। সা.কা. ৩৩ সালের পঞ্চাশত্তমীর দিনে, পবিত্র আত্মা বর্ষিত হওয়ার পর, নারী ও পুরুষ সমস্ত শিষ্য জনসাধারণ্যে ঈশ্বরের মহৎ মহৎ কাজের বিষয়ে বলেছিলেন। স্তিফানের হত্যার পর যে-তাড়নার ঢেউ বয়ে গিয়েছিল, তাতে যে-খ্রিস্টানরা ছড়িয়ে পড়েছিল, তারা দূরদূরান্তে সুসমাচার ছড়িয়ে দিয়েছিল। প্রায় ২৮ বছর পর পৌল শুধু ক্ষুদ্র পাদরিশ্রেণীকে নয় কিন্তু সমস্ত ইব্রীয় খ্রিস্টানকে লিখেছিলেন, যখন তিনি বলেছিলেন: “আইস, আমরা তাঁহারই দ্বারা ঈশ্বরের উদ্দেশে নিয়ত স্তব-বলি, অর্থাৎ তাঁহার নাম স্বীকারকারী ওষ্ঠাধরের ফল, উৎসর্গ করি।” (ইব্রীয় ১৩:১৫) প্রচার কাজ সম্বন্ধে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে বর্ণনা করে পৌল বলেছিলেন: “কারণ আমি যদিও সুসমাচার প্রচার করি, তবু আমার শ্লাঘা করিবার কিছুই নাই; কেননা অবশ্য বহনীয় ভার আমার উপরে অর্পিত; ধিক্ আমাকে, যদি আমি সুসমাচার প্রচার না করি।” (১ করিন্থীয় ৯:১৬) স্পষ্টতই, প্রথম শতাব্দীর সমস্ত বিশ্বস্ত খ্রিস্টান একইরকম মনে করত।
১৪. বিশ্বাস এবং প্রচারের মধ্যে সম্পর্ক কী?
১৪ বস্তুত, একজন অকৃত্রিম খ্রিস্টানকে প্রচার কাজে অংশ নিতে হয় কারণ সেটা বিশ্বাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পৌল বলেছিলেন: “লোকে হৃদয়ে বিশ্বাস করে, ধার্ম্মিকতার জন্য, এবং মুখে স্বীকার করে, পরিত্রাণের জন্য।” (রোমীয় ১০:১০) শুধু কি মণ্ডলীতে এক ছোট্ট দলই—পাদরিশ্রেণীর মতো—বিশ্বাস অনুশীল করে আর তাই তাদেরই প্রচার করার দায়িত্ব রয়েছে? অবশ্যই না! সমস্ত সত্য খ্রিস্টান প্রভু যিশু খ্রিস্টের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে তোলে এবং অন্যদের কাছে সেই বিশ্বাস সম্বন্ধে ঘোষণা করার জন্য পরিচালিত হয়। নতুবা তাদের বিশ্বাস মৃত। (যাকোব ২:২৬) আমাদের সাধারণ কালের প্রথম শতাব্দীতে সমস্ত অনুগত খ্রিস্টান এভাবে তাদের বিশ্বাস দেখিয়েছিল বলে যিহোবার নামের বিরাট প্রশংসা ধ্বনি শোনা গিয়েছিল।
১৫, ১৬. বিভিন্ন সমস্যা সত্ত্বেও যে প্রচার কাজ বেড়ে চলেছিল, সেই বিষয়ে কয়েকটা উদাহরণ দিন।
১৫ প্রথম শতাব্দীতে যিহোবা তাঁর লোকেদের মণ্ডলীর ভিতরে এবং বাইরে বিভিন্ন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও, বৃদ্ধি দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, প্রেরিত ৬ অধ্যায় ইব্রীয় ভাষী এবং গ্রিক ভাষী ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের মধ্যে মতবিরোধ সম্বন্ধে লিপিবদ্ধ করে। সেই সমস্যা প্রেরিতরা সমাধান করেছিল। এর ফলে আমরা পড়ি: “ঈশ্বরের বাক্য ব্যাপিয়া গেল, এবং যিরূশালেমে শিষ্যদের সংখ্যা অতিশয় বৃদ্ধি পাইতে লাগিল; আর যাজকদের মধ্যে বিস্তর লোক বিশ্বাসের বশবর্ত্তী হইল।”—প্রেরিত ৬:৭.
১৬ পরবর্তী সময়ে, যিহূদিয়ার রাজা হেরোদ আগ্রিপ্প এবং সোর ও সীদোনের লোকদের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। সেই নগরগুলোর অধিবাসীরা তোষামোদমূলক শান্তির প্রস্তাব দেয় এবং এর উত্তরে হেরোদ জনগণের উদ্দেশ ভাষণ দেন। সমবেত জনতা উচ্চৈঃস্বরে বলতে শুরু করে: “এ দেবতার রব, মানুষের নয়।” সঙ্গে সঙ্গে যিহোবার দূত হেরোদ আগ্রিপ্পকে আঘাত করে এবং তিনি মারা যান, “কেননা তিনি ঈশ্বরকে গৌরব প্রদান করিলেন না।” (প্রেরিত ১২:২০-২৩) যারা মনুষ্য শাসকদের ওপর আশা রেখেছিল তাদের জন্য কতই না হতাশাজনক! (গীতসংহিতা ১৪৬:৩, ৪) যাইহোক, খ্রিস্টানরা যিহোবাকে গৌরবান্বিত করে চলে। এর ফলে এই ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও, “ঈশ্বরের বাক্য বৃদ্ধি পাইতে ও ব্যাপ্ত হইতে থাকিল।”—প্রেরিত ১২:২৪.
তখন এবং এখন
১৭. প্রথম শতাব্দীতে বৃদ্ধিরত লোকেরা কী করায় যোগ দিয়েছিল?
১৭ হ্যাঁ, প্রথম শতাব্দীতে পৃথিবীব্যাপী খ্রিস্টান মণ্ডলী যিহোবা ঈশ্বরের উদ্যোগী এবং সক্রিয় প্রশংসাকারীদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। সমস্ত অনুগত খ্রিস্টান সুসমাচার ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে অংশ নিত। কেউ কেউ আগ্রহী ব্যক্তিদের দেখা পেত এবং যিশু যেমন বলেছিলেন সেই অনুসারে তাদেরকে সেই সমস্ত বিষয় মেনে চলতে শিক্ষা দিত, যে-বিষয়ে তিনি আদেশ করেছিলেন। (মথি ২৮:১৯, ২০) এর ফলে মণ্ডলী বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং আরও অনেক অনেক ব্যক্তি প্রাচীন রাজা দায়ূদের সঙ্গে যিহোবার প্রশংসা কীর্তনে যোগ দিয়েছিল। সকলে এই অনুপ্রাণিত কথাগুলোর সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল: “হে প্রভু [“যিহোবা,” NW], আমার ঈশ্বর, আমি সর্ব্বান্তঃকরণে তোমার স্তব করিব, আমি চিরকাল তোমার নামের গৌরব করিব। কেননা আমার পক্ষে তোমার দয়া মহৎ।”—গীতসংহিতা ৮৬:১২, ১৩.
১৮. (ক) প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টান মণ্ডলী এবং আজকের খ্রিস্টীয়জগতের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখা যায়? (খ) পরের প্রবন্ধে কী বিবেচনা করা হবে?
১৮ এগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ঈশ্বরতত্ত্বের অধ্যাপক এলিসন এ. ট্রাইটসের কথাগুলো ভাবিয়ে তোলার মতো। প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে আধুনিক দিনের খ্রিস্টীয়জগতের তুলনা করে তিনি বলেছিলেন: “আজকে গির্জাগুলো সাধারণত জৈবিক হারে (যখন কোনো স্থানীয় গির্জার পরিবারের ছেলেমেয়েরা ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাসের ঘোষণা করে) বা স্থানান্তরিত হারে (যখন কোনো নতুন ব্যক্তি আরেকটা স্থানীয় গির্জা থেকে তার সদস্যপদ স্থানান্তর করে) বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাইহোক, প্রেরিত পুস্তকে বৃদ্ধি ছিল ধর্মান্তরিত হারে কারণ গির্জা সবেমাত্র এর কাজ শুরু করেছিল।” এর অর্থ কি এই যে সত্য খ্রিস্টধর্ম যিশু যেভাবে বৃদ্ধি পাওয়া উচিত বলেছিলেন, সেভাবে আর বৃদ্ধি পাবে না? অবশ্যই না। সত্য খ্রিস্টানরা আজকে প্রতিটা ক্ষেত্রে জনসাধারণ্যে ঈশ্বরের গৌরব কীর্তন করার বিষয়ে প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টানদের মতোই উদ্যোগী। পরের প্রবন্ধে আমরা এটা দেখব।
আপনি কি ব্যাখ্যা করতে পারেন?
• কোন কোন উপায়ে আমরা ঈশ্বরের গৌরব করি?
• পৌল গীতসংহিতা ১৯:৪ পদের কোন প্রয়োগ করেছিলেন?
• বিশ্বাস এবং প্রচারের মধ্যে সম্পর্ক কী?
• প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টান মণ্ডলী সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য বিষয়টা কী ছিল?
[অধ্যয়ন প্রশ্নাবলি]
[৮, ৯ পৃষ্ঠার চিত্র]
আকাশমণ্ডল অবিরত যিহোবার গৌরবের সাক্ষ্য দেয়
[সৌজন্যে]
Courtesy of Anglo-Australian Observatory, photograph by David Malin
[১০ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
প্রচার কাজ এবং প্রার্থনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত