সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যিহোবাকে সেবা করতে উৎসুক, তা সেটা যেখানেই হোক না কেন

যিহোবাকে সেবা করতে উৎসুক, তা সেটা যেখানেই হোক না কেন

জীবনকাহিনি

যিহোবাকে সেবা করতে উৎসুক, তা সেটা যেখানেই হোক না কেন

বলেছে মার্কুস এবং ইয়ানি হার্টলিফ

আমি এর আগে কখনো নিজে নিজে প্রচার করিনি। আমি এতটাই ভীতু ছিলাম যে, প্রত্যেক বার প্রচারে বের হওয়ার পর আমার দুই পা কাঁপতে থাকত। এর চেয়ে আরও খারাপ বিষয় হল, সেই এলাকার লোকেরা একেবারেই সাড়া দিত না। কিছু লোক আক্রমণাত্মক ছিল এবং আমাকে মারধর করার হুমকি দিয়েছিল। আমার অগ্রগামী পরিচর্যার প্রথম মাসে আমি কেবল একটি পুস্তিকা অর্পণ করতে পেরেছিলাম!—মার্কুস।

এটা ছিল ৬০ বছরেরও বেশি সময় আগে ১৯৪৯ সালের কথা, তবে আমার কাহিনি শুরু হয়েছিল আরও অনেক বছর আগে। আমার বাবা হেনড্রিক নেদারল্যান্ডসের উত্তর ড্রেন্থের একটা ছোট্ট গ্রাম ডোনডেরেনে একজন মুচির এবং মালির কাজ করতেন। আমি ১৯২৭ সালে সেখানে জন্মগ্রহণ করি আর সাত জন সন্তানের মধ্যে আমি ছিলাম চতুর্থ। আমাদের বাড়িটা ছিল প্রত্যন্ত জেলার এক মাটির রাস্তার পাশে। আমাদের অধিকাংশ প্রতিবেশী ছিল কৃষক আর আমি খেতখামারে কাজ করতে পছন্দ করতাম। ১৯৪৭ সালে, আমার বয়স যখন ১৯ বছর, তখন আমি আমাদের একজন প্রতিবেশী টিউনিস বেনের মাধ্যমে সত্য জানতে পারি। আমার মনে আছে, টিউনিসের সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয় হয়, তখন আমি তাকে খুব একটা পছন্দ করিনি কিন্তু ২য় বিশ্বযুদ্ধের কিছু সময় পরেই তিনি একজন যিহোবার সাক্ষি হন এবং আমি লক্ষ করি যে, তিনি আগের চেয়ে আরও বেশি বন্ধুত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছেন। ব্যক্তিত্বের এই পরিবর্তন আমার মধ্যে কৌতূহল জাগিয়ে তোলে আর তাই তিনি যখন এক পরমদেশ পৃথিবীর বিষয়ে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা সম্বন্ধে আমাকে বলেন, তখন আমি তা মনোযোগ দিয়ে শুনি। আমি খুব শীঘ্র সত্য গ্রহণ করে নিই এবং পরবর্তী সময়ে আমরা চিরদিনের জন্য বন্ধু হয়ে উঠি। *

১৯৪৮ সালের মে মাসে আমি প্রচার করতে শুরু করি এবং এর ঠিক পরের মাসে, ২০ জুন ইউট্রেচের একটা সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নিই। ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি আমি অগ্রগামীর কাজ শুরু করি এবং আমাকে পূর্ব নেদারল্যান্ডসের বরকুলোতে কার্যভার দেওয়া হয়, যেখানে ছোট্ট একটা মণ্ডলী ছিল। সেখানে যাওয়ার জন্য আমাকে ১৩০ কিলোমিটার (৮০ মাইল) পথ পাড়ি দিতে হবে, তাই আমি সেখানে আমার সাইকেলে করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমি ভেবেছিলাম, সেখানে পৌঁছাতে আমার প্রায় ৬ ঘন্টা সময় লাগবে কিন্তু ভারি বৃষ্টিপাত এবং দমকা হাওয়ার কারণে সেখানে পৌঁছাতে ১২ ঘন্টা সময় লাগে, এমনকী যদিও শেষের ৯০ কিলোমিটার (৫৫ মাইল) পথ আমি ট্রেনে করে যাই! অবশেষে, সন্ধ্যা বেলায় আমি আমার গন্তব্যে, এক সাক্ষি পরিবারের বাড়িতে পৌঁছাই আর সেই এলাকায় অগ্রগামীর কাজ করার সময় আমি এই পরিবারের সঙ্গেই থাকা শুরু করি।

যুদ্ধের পরের বছরগুলোতে, লোকেদের খুব বেশি সহায়সম্পদ ছিল না। সর্বসাকুল্যে আমার যা ছিল, তা হল একটা স্যুট এবং একটা প্যান্ট—স্যুটটা অনেক বড়ো এবং প্যান্টটা অনেক ছোটো! শুরুতে আমি যেমন উল্লেখ করেছি যে, বরকুলোতে আমার প্রথম মাসটা অনেক কঠিন ছিল কিন্তু যিহোবা আমাকে কয়েকটা বাইবেল অধ্যয়ন জুগিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ করেন। নয় মাস পর, আমাকে আমস্টারডামে কার্যভার দেওয়া হয়।

গ্রাম থেকে শহরে

যদিও আমি কৃষিপ্রধান একটা জেলায় বড়ো হয়েছি কিন্তু সেই সময় আমি নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে বড়ো শহর আমস্টারডামে উপস্থিত হই। সেখানে পরিচর্যা অত্যন্ত ফলপ্রসূ ছিল। প্রথম মাসেই আমি বিগত নয় মাসের চেয়েও বেশি সাহিত্য বিতরণ করি। শীঘ্র, আমি প্রায় আটটা বাইবেল অধ্যয়ন করাতে শুরু করি। আমাকে মণ্ডলীর দাস (এখন যাকে প্রাচীনগোষ্ঠীর কোঅর্ডিনেটর বলা হয়) হিসেবে নিযুক্ত করার পর, আমি জনসাধারণের উদ্দেশে আমার প্রথম বক্তৃতা দেওয়ার কার্যভার লাভ করি। আমার জন্য এটা কিছুটা ভীতিকর ছিল, তাই যে-সময়টাতে আমার সেই বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল, সেটার ঠিক আগেই যখন আমাকে অন্য একটা মণ্ডলীতে স্থানান্তরিত করা হয়, তখন আমি স্বস্তির এক দীর্ঘশ্বাস ফেলি। সেই সময় কে জানত যে, পরবর্তী বছরগুলোতে আমাকে ৫০০০-এরও বেশি বক্তৃতা দিতে হবে!

১৯৫০ সালের মে মাসে, আমাকে হার্লেমে কার্যভার দেওয়া হয়। এরপর আমাকে সীমার কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিন দিন আমি প্রায় ঘুমাতেই পারিনি। আমি শাখা অফিসে সেবারত একজন ভাই রোবার্ত ভিঙ্কলারকে বলি যে, আমি এই কাজের জন্য নিজেকে যোগ্য বলে মনে করি না, কিন্তু তিনি বলেন: “কোনো কথা না বলে কেবল ফর্ম পূরণ করো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিখে যাবে।” এর কিছু সময় পরেই, আমাকে এক মাস ধরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং আমি একজন সীমা দাস (অধ্যক্ষ) হিসেবে সেবা করতে শুরু করি। একটা মণ্ডলী পরিদর্শন করার সময়, ইয়ানি টাটখেন নামে অল্পবয়সি একজন হাসিখুশি অগ্রগামী বোনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, যার যিহোবার প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং এক আত্মত্যাগমূলক মনোভাব রয়েছে। আমরা ১৯৫৫ সালে বিয়ে করি। কিন্তু, আমার কাহিনি আরও বলার আগে, ইয়ানি বর্ণনা করবে যে, কীভাবে সে একজন অগ্রগামী হয়ে ওঠে এবং বিয়ের পর কীভাবে আমরা একত্রে সেবা করি।

বিবাহিত দম্পতি হিসেবে সেবা করা

ইয়ানি: ১৯৪৫ সালে, যখন আমার বয়স ১১ বছর, তখন আমার মা একজন সাক্ষি হন। তিনি সঙ্গেসঙ্গে উপলব্ধি করতে পারেন যে, তার তিন সন্তানের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আমার বাবা সত্যের বিরোধিতা করতেন। তাই, মা আমাদেরকে বাবা যখন ঘরে থাকতেন না, তখন শিক্ষা দিতেন।

সর্বপ্রথম আমি যে-সভাতে যোগদান করি, সেটা হল ১৯৫০ সালে হেগ শহরে অনুষ্ঠিত একটা সম্মেলন। এক সপ্তাহ পর, আমি আসেনের (ড্রেন্থের) এক স্থানীয় কিংডম হলে আমার প্রথম সভায় যোগদান করেছিলাম। আমার বাবা রেগে আগুন হয়ে যান এবং আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। আমার মা বলেন, “তুমি তো জানোই, তোমাকে কোথায় যেতে হবে।” আমি জানতাম যে, তিনি আমার আধ্যাত্মিক ভাই-বোন সম্বন্ধে বলছেন। প্রথমে আমি কাছাকাছি বসবাসরত এক সাক্ষি পরিবারের কাছে যাই কিন্তু আমার বাবার কারণে সেখানে থাকাও আমার জন্য কঠিন হয়ে ওঠে, তাই আমি প্রায় ৯৫ কিলোমিটার (৬০ মাইল) দূরে অবস্থিত ডাভিনটার (ওভারিজিসল) মণ্ডলীতে চলে যাই। তবে, আমি যেহেতু অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলাম, তাই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ায় সরকারি কর্তৃপক্ষ বাবার ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে, তিনি আমাকে বলেন, আমি বাড়িতে ফিরে আসতে পারি। যদিও আমার বাবা কখনোই সত্য গ্রহণ করে নেননি কিন্তু অবশেষে তিনি আমাকে সমস্ত সভায় যোগদান করার এবং প্রচারে যাওয়ার অনুমতি দেন।

আমি বাড়িতে ফিরে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই আমার মা অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন আর তাই আমাকে ঘরের সমস্ত কাজ করতে হতো। এই পরিস্থিতি সত্ত্বেও, আমি আধ্যাত্মিকভাবে উন্নতি করে চলি এবং ১৯৫১ সালে ১৭ বছর বয়সে বাপ্তিস্ম নিই। ১৯৫২ সালে, মা সুস্থ হয়ে ওঠার পর আমি তিন জন অগ্রগামী বোনের সঙ্গে দুই মাস অবকাশ (সহায়ক) অগ্রগামী হিসেবে সেবা করি। আমরা একটা হাউসবোটে থাকতাম এবং ড্রেন্থের দুটো শহরে প্রচার করতাম। ১৯৫৩ সালে, আমি একজন নিয়মিত অগ্রগামী হই। এক বছর পর, তুলনামূলকভাবে কমবয়সি একজন সীমা অধ্যক্ষ আমাদের মণ্ডলী পরিদর্শন করেছিলেন। সে ছিল মার্কুস। আমরা ১৯৫৫ সালের মে মাসে বিয়ে করি কারণ আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, দম্পতি হিসেবে আমরা যিহোবাকে আরও ভালোভাবে সেবা করতে পারব।—উপ. ৪:৯-১২.

মার্কুস: আমাদের বিয়ের পর, প্রথমে আমাদেরকে ভেনডামে (গ্রনিন্‌গেনে) অগ্রগামী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। আমরা ছোট্ট একটা রুমে থাকতাম, যেটা কেবল ২ মিটার লম্বা এবং ৩ মিটার চওড়া (সাত ফুট লম্বা এবং দশ ফুট চওড়া) ছিল। যাই হোক, ইয়ানি সেই রুম অনেক সুন্দর এবং আরামদায়ক করে তুলেছিল। প্রতি রাতে, আমাদের টেবিল এবং ছোটো চেয়ার দুটো সরিয়ে রাখতে হতো, যাতে আমরা ওয়াল বেডটা নামিয়ে ব্যবহার করতে পারি।

ছয় মাস পর, আমাদেরকে বেলজিয়ামে ভ্রমণের কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৫৫ সালে, সেই দেশে প্রায় ৪,০০০ জন প্রকাশক ছিল। কিন্তু, এখন সেখানে এই সংখ্যা ছয় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে! উত্তর বেলজিয়ামের ফ্লন্ডোর্সের লোকেরা নেদারল্যান্ডসের মতো একই ভাষায় কথা বলে। কিন্তু, বেলজিয়ামের লোকেদের বাচনভঙ্গি বেশ আলাদা আর তাই প্রথমে আমাদেরকে ভাষার প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাটিয়ে উঠতে হয়েছিল।

ইয়ানি: ভ্রমণের কাজের জন্য প্রকৃত আত্মত্যাগমূলক মনোভাবের প্রয়োজন। আমরা আমাদের সাইকেলে করে মণ্ডলীগুলো পরিদর্শন করতাম এবং আমাদের ভাইবোনদের বাড়িতে থাকতাম। এক মণ্ডলী থেকে আরেক মণ্ডলীতে যাওয়ার সময় থাকার জন্য যেহেতু আমাদের নিজস্ব কোনো জায়গা ছিল না, তাই আমরা ভাইবোনদের বাড়িতে সোমবার পর্যন্ত থাকতাম এবং মঙ্গলবার সকালে অন্য মণ্ডলীতে যেতাম। কিন্তু, আমরা সবসময়ই আমাদের সেবাকে যিহোবার কাছ থেকে একটা আশীর্বাদ বলে মনে করেছি।

মার্কুস: প্রথমদিকে, আমরা মণ্ডলীর কোনো ভাই বা বোনকে চিনতাম না কিন্তু তারা অত্যন্ত সদয় এবং অতিথিপরায়ণ ছিল। (ইব্রীয় ১৩:২) কয়েক বছর ধরে, আমরা বেলজিয়ামের সমস্ত ডাচভাষী মণ্ডলী বেশ কয়েক বার পরিদর্শন করি। এর ফলে আমরা অনেক আশীর্বাদ লাভ করি। উদাহরণস্বরূপ, আমরা ডাচভাষী এলাকার প্রায় প্রত্যেক ভাই ও বোনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠি এবং তারা আমাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠে। আমরা অসংখ্য যুবক-যুবতীকে দৈহিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে বৃদ্ধি পেতে ও সেইসঙ্গে যিহোবার কাছে নিজেদের উৎসর্গ করতে, তাদের জীবনে রাজ্যের বিষয়গুলোকে প্রথমে রাখতে দেখেছি। তাদের মধ্যে অনেককে পূর্ণসময়ের পরিচর্যায় যিহোবাকে বিশ্বস্তভাবে সেবা করতে দেখা প্রকৃতই আনন্দদায়ক। (৩ যোহন ৪) এই ‘উভয় পক্ষের আশ্বাসের’ ফলে আমরা সহজেই সর্বান্তকরণে আমাদের কার্যভার চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম।—রোমীয় ১:১২.

বিরাট এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রকৃত এক আশীর্বাদ

মার্কুস: বিয়ের দিন থেকেই আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল আমরা গিলিয়েড স্কুল-এ যোগ দেব। প্রতিদিন, আমরা অন্ততপক্ষে এক ঘন্টা করে ইংরেজি ভাষা নিয়ে অধ্যয়ন করতাম। কিন্তু, বই থেকে ইংরেজি শেখা সহজ ছিল না, তাই আমরা আমাদের ছুটির সময় ইংল্যান্ডে গিয়ে সেখানে প্রচার করার পাশাপাশি ভাষা চর্চা করার সিদ্ধান্ত নিই। অবশেষে, ১৯৬৩ সালে আমরা ব্রুকলিনের বিশ্বপ্রধান কার্যালয় থেকে একটা খাম পাই। এর মধ্যে দুটো চিঠি ছিল, একটা আমার জন্য আর অন্যটা ইয়ানির জন্য। আমার চিঠিটা ছিল গিলিয়েডে দশ মাসব্যাপী বিশেষ ক্লাসে যোগ দেওয়ার একটা আমন্ত্রণ। মূলত ভাইদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করার এবং সাংগঠনিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য এই কোর্সের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাই, যে-১০০ জন ছাত্রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে ৮২ জনই ছিল ভাই।

ইয়ানি: সেইদিন আমি যে-চিঠি পেয়েছিলাম, সেখানে আমাকে প্রার্থনাপূর্বক বিবেচনা করতে বলা হয়েছিল যে, মার্কুস যে-সময়টাতে গিলিয়েডে থাকবে, সেই সময়টাতে আমি বেলজিয়ামে থাকতে ইচ্ছুক কি না। এটা ঠিক যে, প্রথমে আমি হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে আমার প্রচেষ্টায় যিহোবা আশীর্বাদ করেননি। কিন্তু, আমি আবারও গিলিয়েড স্কুল-এর উদ্দেশ্য নিয়ে চিন্তা করেছিলাম আর তা হল, যারা সেখানে উপস্থিত হয়, তাদেরকে বিশ্বব্যাপী সুসমাচার প্রচারের কাজ সম্পাদন করার জন্য সাহায্য করা। তাই, আমি থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই আর আমাকে বেলজিয়ামের গেন্ট নামে একটা শহরে অ্যানা এবং মারিয়া কোলপার্ট নামে দুই জন অভিজ্ঞ বিশেষ অগ্রগামী বোনের সঙ্গে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়।

মার্কুস: যেহেতু ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রে আমার উন্নতি করার প্রয়োজন ছিল, তাই আমাকে স্কুল শুরু হওয়ার পাঁচ মাস আগেই ব্রুকলিনে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি শিপিং এবং সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। বিশ্বপ্রধান কার্যালয়ে সেবা করা এবং এশিয়া, ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকায় পাঠানোর জন্য সাহিত্যাদি প্রস্তুত করা আমাকে আমাদের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃসমাজ সম্বন্ধে আরও জানতে সাহায্য করেছিল। আমি বিশেষভাবে ভাই এ. এইচ. ম্যাকমিলানের কথা স্মরণ করতে পারি, যিনি ভাই রাসেলের সময়কালে একজন পিলগ্রিম (ভ্রমণ অধ্যক্ষ) হিসেবে সেবা করেছিলেন। সেই সময় তিনি বৃদ্ধ এবং প্রায় বধির হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু তার পরও তিনি বিশ্বস্তভাবে মণ্ডলীর প্রতিটা সভায় যোগদান করতেন। এটা আমার ওপর এক গভীর ছাপ ফেলেছিল এবং আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছিল যে, খ্রিস্টীয় মেলামেশাকে আমাদের কখনোই হালকাভাবে দেখা উচিত নয়।—ইব্রীয় ১০:২৪, ২৫.

ইয়ানি: মার্কুস এবং আমি সপ্তাহে বেশ কয়েক বার যোগাযোগ করতাম। আমরা একে অপরকে অনেক মিস্‌ করতাম! যাই হোক, মার্কুস গিলিয়েডে যে-প্রশিক্ষণ লাভ করে, সেটা সে উপভোগ করে এবং আমি আমার পরিচর্যায় প্রকৃত আনন্দ খুঁজে পাই। মার্কুস যখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসে, তখন আমার বাইবেল অধ্যয়ন ছিল ১৭টা! ১৫ মাস ধরে আলাদা থাকা আমাদের জন্য সত্যিই এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল কিন্তু আমি দেখতে পেরেছি যে, আমাদের আত্মত্যাগের জন্য যিহোবা আমাদের আশীর্বাদ করেছেন। মার্কুসের ফিরে আসার দিন প্লেন বেশ কয়েক ঘন্টা বিলম্ব করে, তাই অবশেষে সে যখন পৌঁছায়, তখন আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি। এরপর থেকে, আমরা আর কখনো আলাদা হইনি।

সেবার প্রতিটা বিশেষ সুযোগের জন্য কৃতজ্ঞ

মার্কুস: ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি যখন গিলিয়েড থেকে ফিরে আসি, তখন আমাদেরকে বেথেলে সেবা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু সেই সময় আমরা জানতাম না যে, সেটা আমাদের জন্য স্থায়ী কার্যভার হবে না। মাত্র তিন মাস পরে, আমাদেরকে ফ্লন্ডোর্সে জেলার কাজে নিযুক্ত করা হয়। আলজেন এবং এলস্‌ ভিখারস্মাকে যখন বেলজিয়ামে মিশনারি হিসেবে পাঠানো হয়, তখন তাদেরকে জেলার কাজে নিযুক্ত করা হয় আর আমরা বেথেলে ফিরে যাই, যেখানে আমি সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে কাজ করি। ১৯৬৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আমাদের কার্যভার বেশ কয়েক বার বেথেল সেবা থেকে ভ্রমণের কাজে পরিবর্তিত হয়। অবশেষে, ১৯৮০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আমি পুনরায় একজন জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করি।

যদিও আমাদের কার্যভার প্রায়ই পরিবর্তিত হয়েছে, তবুও আমরা কখনোই এই বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলিনি যে, আমরা নিজেদের জীবন যিহোবাকে পূর্ণহৃদয়ে সেবা করার জন্য উৎসর্গ করেছি। আমরা এই আস্থা রেখে আমাদের প্রতিটা কার্যভার সত্যিই উপভোগ করেছি যে, আমাদের সেবায় যেকোনো পরিবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যের বিষয়গুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

ইয়ানি: আমি বিশেষভাবে মার্কুসের সঙ্গে ১৯৭৭ সালে ব্রুকলিনে এবং ১৯৯৭ সালে—যখন সে শাখা কমিটির সদস্য হিসেবে আরও প্রশিক্ষণ লাভ করেছে—প্যাটারসনে যাওয়ার চমৎকার সুযোগ উপভোগ করেছি।

যিহোবা আমাদের প্রয়োজনগুলো জানেন

মার্কুস: ১৯৮২ সালে, ইয়ানির একটা অস্ত্রোপচার হয় আর এরপর সে সুস্থ হয়ে ওঠে। তিন বছর পর, লুভেইন মণ্ডলী সদয়ভাবে আমাদেরকে তাদের কিংডম হলের ওপরে একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকার আমন্ত্রণ জানায়। গত ৩০ বছরের মধ্যে এই প্রথম আমাদের নিজেদের থাকার একটা ছোট্ট জায়গা হয়। মঙ্গলবার আমরা যখন কোনো মণ্ডলী পরিদর্শন শুরু করার জন্য জিনিসপত্র গোছগাছ করতাম, তখন আমাদের লাগেজ নীচে নামানোর জন্য আমাকে বেশ কয়েক বার ৫৪-টা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে এবং ওপরে উঠতে হতো! আনন্দের বিষয় হল, ২০০২ সালে এমন ব্যবস্থা করা হয়, যেন আমরা নীচ তলার একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে পারি। আমার বয়স যখন ৭৮ বছর, তখন আমাদেরকে লোকারে শহরে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে, আমরা এভাবে সেবা করতে পারছি এবং এখনও প্রতিদিন ক্ষেত্রে যেতে পারছি।

ইয়ানি: আমরা পূর্ণসময়ের পরিচর্যায় মোট ১২০ বছরেরও বেশি সময় কাটাতে পেরেছি! আমরা সরাসরি যিহোবার এই প্রতিজ্ঞাগুলোর সত্যতা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, ‘তিনি কোন ক্রমে আমাদিগকে ছাড়িবেন না’ এবং আমরা যদি তাঁকে বিশ্বস্তভাবে সেবা করি, তাহলে আমাদের ‘কিছুরই অভাব হইবে না।’—ইব্রীয় ১৩:৫; দ্বিতীয়. ২:৭.

মার্কুস: আমাদের বয়স যখন কম ছিল, তখন আমরা যিহোবার কাছে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছি। আমরা কখনোই নিজেদের জন্য মহৎ মহৎ বিষয়ের চেষ্টা করিনি। আমাদেরকে যখন যে-কার্যভারই দেওয়া হোক না কেন, আমরা তা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক কারণ আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমরা কোথায় সেবা করি বা কতটুকু করতে পারি, সেটা নয় বরং আমরা কাকে সেবা করি, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

[পাদটীকা]

^ পরবর্তী সময়ে, আমার বাবা, মা, একজন দিদি এবং দুই জন ছোটো ভাইও সাক্ষি হয়।

[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

ওপরে: ১৯৫০ সালে, মার্কুস (একেবারে ডানে) আমস্টারডামের কাছে একটা রাস্তায় সাক্ষ্যদান করছেন

[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

নীচে: ১৯৫২ সালে, ইয়ানি (একেবারে ডানে) অবকাশ অগ্রগামীর কাজ করছেন

[২৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

ডানে: ১৯৫৫ সালে আমাদের বিয়ের দিন

[৩০ পৃষ্ঠার চিত্র]]

[৩১ পৃষ্ঠার চিত্র]

[৩১ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

“আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমরা কোথায় সেবা করি বা কতটুকু করতে পারি, সেটা নয় বরং আমরা কাকে সেবা করি, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়”