জীবনকাহিনি
রাজ্যের সেবায় আমার জীবনের বিভিন্ন মাইলফলক
১৯৪৭ সালে, এল সালভাদরের সান্তা অ্যানায় ক্যাথলিক যাজকরা সাক্ষিদের জন্য বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। মিশনারি হোমে ভাই-বোনেরা যখন তাদের সাপ্তাহিক প্রহরীদুর্গ অধ্যয়ন করছিল, তখন কিছু যুবক খোলা দরজা দিয়ে বড়ো বড়ো পাথর ছুড়ে মেরেছিল। আর এরপর যাজকদের নেতৃত্বে একটা মিছিল এগিয়ে এসেছিল। তাদের কারো হাতে ছিল মশাল; আবার কারো হাতে ছিল মূর্তি ও ছবি। দুই ঘণ্টা ধরে তারা বিল্ডিং লক্ষ করে পাথর ছুড়ে মেরেছিল এবং বার বার এই কথা বলেছিল: “কুমারী মরিয়ম চিরজীবি হোক!” আর “যিহোবার মৃত্যু হোক!” মিশনারিদের ভয় দেখিয়ে শহর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য এটা করা হয়েছিল। আমি এই ঘটনা জানি, কারণ আমিও একজন মিশনারি ছিলাম এবং ৬৭ বছর আগে সেই সভায় যোগ দিয়েছিলাম। *
ওপরের ঘটনা ঘটার দু-বছর আগে, আমার মিশনারি সঙ্গী এভলিন ট্রেবার্ট এবং আমি ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অভ্ গিলিয়েড-এর ৪র্থ ক্লাস থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলাম। তখন এই স্কুল নিউ ইয়র্কের কাছাকাছি ইথেকায় অবস্থিত ছিল। আমাদেরকে সান্তা অ্যানায় সেবা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। প্রায় ২৯ বছরের মিশনারি সেবার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরার আগে, আমি আপনাদের বলছি, কেন আমি এই কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
আমার আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার
১৯২৩ সালে আমার জন্মের সময়, আমার বাবা-মা জন ও ইভা ওলসন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের স্পোকানে বাস করত। যদিও তারা লুথারিয়ান গির্জার সদস্য ছিল, কিন্তু তারা নরকাগ্নির শিক্ষা গ্রহণ করেনি। কারণ তারা এই শিক্ষাকে একজন প্রেমময় ঈশ্বরের প্রতি তাদের বিশ্বাসের সঙ্গে মেলাতে পারত না। (১ যোহন ৪:৮) বাবা একটা বেকারিতে কাজ করতেন। এক রাতে তার সহকর্মী তাকে এই বিষয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন, নরক যাতনার এক স্থান, এটা বাইবেলের শিক্ষা নয়। শীঘ্রই আমার বাবা-মা যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেছিল এবং মৃত্যুর পরে জীবন সম্বন্ধে বাইবেল প্রকৃতপক্ষে কী শিক্ষা দেয়, তা জানতে পেরেছিল।
আমার বয়স তখন মাত্র নয় বছর, কিন্তু আমার মনে আছে, বাবা-মা বাইবেলের সত্যের ব্যাপারে তাদের নতুন বিশ্বাস সম্বন্ধে উদ্যমের সঙ্গে কথাবার্তা বলত। তারা যখন সত্য ঈশ্বরের নাম যিহোবা, তা জানতে পেরেছিল এবং বিভ্রান্তিকর ত্রিত্বের মতবাদ থেকে মুক্ত হয়েছিল, তখন তাদের উদ্যম আরও বেড়ে গিয়েছিল। আমি একটা স্পঞ্জের মতো এই চমৎকার শাস্ত্রীয় শিক্ষাগুলো শুষে নিতে শুরু করেছিলাম অর্থাৎ সেই “সত্য” শিখতে শুরু করেছিলাম, যা ‘একজনকে স্বাধীন করিবে।’ (যোহন ৮:৩২) তাই, বাইবেল অধ্যয়ন করাকে আমার কাছে কখনোই একঘেয়ে বলে মনে হতো না। এর পরিবর্তে, ঈশ্বরের বাক্য পরীক্ষা করতে আমার সবসময়ই ভালো লাগত। যদিও আমি লাজুক স্বভাবের ছিলাম, তবুও আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রচার কাজে অংশ নিতাম। তারা ১৯৩৪ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। ১৯৩৯ সালে, ১৬ বছর বয়সে যিহোবার একজন বাপ্তাইজিত দাস হিসেবে আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দিই।
১৯৪০ সালের জুলাই মাসে, আমার বাবা-মা তাদের বাড়ি বিক্রি করে দেয় আর আমরা তিন জন ইদাহোর কর দি ল্যানে অগ্রগামী হিসেবে পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করি। আমরা ভাড়া করা একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম। এই অ্যাপার্টমেন্ট একটা গাড়ি মেরামত করার দোকানের ওপরের তলায় ছিল। আমাদের ঘর সভার স্থান হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। সেই সময়ে অল্প কয়েকটা মণ্ডলীর নিজস্ব কিংডম হল ছিল আর তাই বেশিরভাগ মণ্ডলী কারো বাড়িতে অথবা ভাড়া করা ঘরে মিলিত হতো।
১৯৪১ সালে আমার বাবা-মা এবং আমি মিজৌরির সেন্ট লুইসে অনুষ্ঠিত একটা সম্মেলনে যোগ দিই। রবিবার দিন ছিল “শিশু দিবস” আর যাদের বয়স ৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে, তারা মঞ্চের একেবারে সামনের দিকে বসেছিল। ভাই জোসেফ এফ. রাদারফোর্ড তার বক্তৃতার শেষের দিকে অল্পবয়সিদের উদ্দেশে বলেছিলেন: “তোমাদের মধ্যে যে-ছেলে-মেয়েরা . . . ঈশ্বর ও তাঁর রাজার বাধ্য থাকতে রাজি আছ, তারা দয়া করে উঠে দাঁড়াও!” আমরা সকলে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। এরপর, ভাই রাদারফোর্ড জোর দিয়ে বলেছিলেন: “দেখুন, রাজ্যের ১৫,০০০-রেরও বেশি নতুন সাক্ষি!” এই ঘটনা অগ্রগামী হিসেবে আমার কেরিয়ার বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে দৃঢ় করতে সাহায্য করেছিল।
আমাদের পরিবারের বিভিন্ন কার্যভার
সেন্ট লুইসে অনুষ্ঠিত সম্মেলন শেষ হওয়ার কয়েক মাস পর, আমাদের পরিবার ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে চলে গিয়েছিল। সেখানে আমাদেরকে অক্সনার্ড শহরে একটা মণ্ডলী শুরু করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমরা একটা ছোটো ট্রেইলার বা ভ্রাম্যমাণ বাড়িতে থাকতাম, যেখানে কেবল একটা বিছানা ছিল। প্রতি রাতে আমাকে আমাদের ডাইনিং টেবিলের ওপর “বিছানা” করতে হতো। আমার আগের বেডরুমের চেয়ে তা কতই-না আলাদা ছিল!
ক্যালিফোর্নিয়ায় আসার ঠিক আগে, ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর হাওয়াইয়ের পার্ল হারবারের ওপর জাপান আক্রমণ করে। ঠিক পরের দিন, যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়। কর্তৃপক্ষের আদেশ অনুযায়ী রাতের বেলা আমাদের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিতে হতো। জাপানি সাবমেরিনগুলো ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে টহল দিত আর পুরোপুরি অন্ধকার থাকায় তারা মূল ভূখণ্ডের লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ করতে পারত না।
কয়েক মাস পর, ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমরা ওহাইওর ক্লিভল্যান্ডে অনুষ্ঠিত নতুন জগৎ ঈশতান্ত্রিক সম্মেলন-এ যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে আমরা ভাই নেথেন এইচ. নরের বক্তৃতা শুনেছিলাম, যেটার শিরোনাম ছিল, “শান্তি—এটি কি স্থায়ী হতে পারে?” তিনি প্রকাশিত বাক্য ১৭ অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, যেখানে সেই “পশু” সম্বন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে, যে “ছিল, কিন্তু নাই; সে অগাধলোক হইতে উঠিবে।” (প্রকা. ১৭:৮, ১১) ভাই নর ব্যাখ্যা করেছিলেন, সেই “পশু” ছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ, যেটার কার্যক্রম ১৯৩৯ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাইবেল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, রাষ্ট্রপুঞ্জের স্থলে কিছু আসবে, যা তুলনামূলকভাবে এক শান্তিপূর্ণ সময়ের দিকে নিয়ে যাবে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এরপর, সেই “পশু” রাষ্ট্রসংঘ হিসেবে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছিল। যিহোবার সাক্ষিরা সেই সময়ে বিশ্বব্যাপী তাদের প্রচার কাজ সম্প্রসারিত করেছিল আর তখন থেকে প্রচুর বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে!
সেই ভবিষ্যদ্বাণী আমাকে দেখতে সাহায্য করেছিল সামনে কী রয়েছে। যখন ঘোষণা করা হয়েছিল, আগামী বছর থেকে গিলিয়েড স্কুল শুরু হবে, তখন আমার মধ্যে মিশনারি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল। ১৯৪৩ সালে, আমাকে অরেগনের পোর্টল্যান্ডে অগ্রগামী হিসেবে কার্যভার দেওয়া হয়। সেই সময়ে, আমরা দরজার সামনে গৃহকর্তাকে ধর্মীয় উপদেশ বাজিয়ে শোনানোর জন্য ফোনোগ্রাফ ব্যবহার করতাম। তারপর, তাদেরকে ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে বিভিন্ন বাইবেল সাহিত্যাদি নেওয়ার প্রস্তাব দিতাম। পুরো বছর ধরে আমি মিশনারি সেবা নিয়ে চিন্তা করেছিলাম।
১৯৪৪ সালে, আমি আমার প্রিয় বান্ধবী এভলিন ট্রেবার্টের সঙ্গে গিলিয়েড যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে অনেক রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। পাঁচ মাস ধরে আমাদের নির্দেশকরা দেখিয়েছিল, কীভাবে বাইবেল অধ্যয়ন থেকে আনন্দ লাভ করা যায়। তাদের নম্রতা আমাদের অভিভূত করেছিল। আমরা যখন খাবার খেতাম, তখন কখনো কখনো সেই ভাইয়েরা ওয়েটার হিসেবে কাজ করত। আমরা ১৯৪৫ সালের ২২ জানুয়ারি গ্র্যাজুয়েট হই।
আমার মিশনারি কার্যভার
এভলিন ও আমি, ১৯৪৬ সালের জুন মাসে লিও এবং এসথার মাহানের সঙ্গে আমাদের কার্যভারের জায়গা এল সালভাদরে এসে পৌঁছাই। সেখানে আমরা দেখতে পাই, শস্য “কাটিবার মত শ্বেতবর্ণ হইয়াছে।” (যোহন ৪:৩৫) এই কাহিনির শুরুতে উল্লেখিত ঘটনাটা দেখায় যে, পাদরিরা কতটা ক্রুদ্ধ হয়েছিল। এর মাত্র এক সপ্তাহ আগে, সান্তা অ্যানায় আমাদের প্রথম সীমা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমরা জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতা সম্বন্ধে ব্যাপকভাবে প্রচার করেছিলাম। প্রায় ৫০০ জন লোক যখন সেখানে উপস্থিত হয়েছিল, তখন তা দেখে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম। ভয় পেয়ে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার পরিবর্তে, আমরা সেখানে থেকে সৎহৃদয়ের ব্যক্তিদের সাহায্য করার জন্য আরও দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলাম। যদিও পাদরিরা লোকেদের বাইবেল পড়তে নিষেধ করেছিল এবং খুব কম লোকের কাছেই বাইবেলের একটা নিজস্ব কপি ছিল, তবুও অনেকে সত্যের জন্য ক্ষুধার্ত ছিল। এ ছাড়া, তারা আমাদের স্প্যানিশ শেখার প্রচেষ্টা দেখেও উপলব্ধি প্রকাশ করেছিল। কারণ তারা যাতে সত্য ঈশ্বর এবং পৃথিবীকে পরমদেশে পরিণত করার বিষয়ে তাঁর অপূর্ব প্রতিজ্ঞা সম্বন্ধে শিখতে পারে, সেজন্য আমরা স্প্যানিশ ভাষা শিখেছিলাম।
রোজা অ্যাসেনসিও ছিলেন আমার প্রথম দিকের ছাত্রীদের মধ্যে একজন। বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করার পর, তিনি সেই পুরুষের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন, যার সঙ্গে তিনি থাকতেন। এরপর, সেই পুরুষ বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেন। তারা বিয়ে করে, এরপর বাপ্তাইজিত হয় এবং যিহোবার উদ্যোগী সাক্ষি হয়ে ওঠে। রোজা ছিলেন সান্তা অ্যানার প্রথম স্থানীয় অগ্রগামী। *
রোজার একটা ছোটো মুদির দোকান ছিল। পরিচর্যায় যাওয়ার সময় তিনি দোকান বন্ধ রাখতেন এবং তার প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জোগানোর জন্য যিহোবার ওপর নির্ভর করতেন। কয়েক ঘণ্টা পর তিনি যখন আবার দোকান খুলতেন, তখন তার দোকান ক্রেতায় ভরে যেত। তিনি মথি ৬:৩৩ পদের সত্যতা নিজের চোখে দেখতে পেয়েছিলেন এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন।
একবার সেখানকার স্থানীয় পাদরি আমাদের বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করেন এবং সাবধান করে দেন। তিনি বলেন, বাড়িওয়ালা যদি আমাদের ছয় জন মিশনারিকে বাড়ি ছাড়তে না বলেন, তাহলে তাকে ও তার স্ত্রীকে গির্জা থেকে বহিষ্কার করা হবে। আমাদের বাড়িওয়ালা, যিনি একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন, তিনি ইতিমধ্যেই পাদরিদের আচার-আচরণে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন আর তাই তিনি তার কথায় কান দেননি। তিনি এমনকী সেই গির্জার পাদরিকে বলেছিলেন, গির্জা থেকে তাকে বহিষ্কার করে দিলেও তার কোনো আপত্তি নেই। বাড়িওয়ালা আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, যতদিন খুশি আমরা সেই বাড়িতে থাকতে পারি।
একজন সম্মাননীয় নাগরিক, সাক্ষি হন
আরেক জন মিশনারি, রাজধানী সান সালভাদরে একজন প্রকৌশলীর স্ত্রীর সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করছিলেন। সেই প্রকৌশলীর নাম হল বাল্টাজার পের্লা। সৎহৃদয়ের সেই ব্যক্তি ধর্মীয় নেতাদের কপটতা দেখে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। যখন একটা শাখা অফিস নির্মাণ করার প্রয়োজন হয়েছিল, সেই সময়ে বাল্টাজার—যিনি তখনও সত্যে আসেননি—ওই বিল্ডিংয়ের নকশা ও নির্মাণকাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর এই কাজের জন্য তিনি কোনো টাকাপয়সা নেননি।
নির্মাণ প্রকল্পে যিহোবার লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করার পর, বাল্টাজার এই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, তিনি সত্য ধর্ম খুঁজে পেয়েছেন। ১৯৫৫ সালে ২২ জুলাই তিনি বাপ্তিস্ম নেন আর এর অল্পসময় পরে তার স্ত্রী পাওলিনাও বাপ্তিস্ম নেন। তাদের দুই ছেলে-মেয়ে বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করছে। তার ছেলে বাল্টাজার জুনিয়র ৪৯ বছর ধরে ব্রুকলিন বেথেলে সেবা করছেন, যেখানে তিনি ক্রমবর্ধমান প্রচার কাজকে সমর্থন করে যাচ্ছেন। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শাখা কমিটি-তে সেবা করছেন। *
আমরা যখন সান সালভাদরে সম্মেলনের ব্যবস্থা করতে শুরু করেছিলাম, তখন ভাই পের্লা আমাদের সাহায্য করেছিলেন, যাতে আমরা সম্মেলন করার জন্য একটা বড়ো ব্যায়ামগার ব্যবহার করতে পারি। প্রথম প্রথম আমরা কেবল কয়েক সারি আসন ব্যবহার করেছিলাম; কিন্তু যিহোবার আশীর্বাদে আমাদের আসনের সারির সংখ্যা বছর বছর বাড়তে থাকে আর একসময়ে পুরো ব্যায়ামাগার ভরে যায়, এমনকী সেখানে আর কোনো জায়গা থাকে না! সেইসমস্ত আনন্দময় মুহূর্তে আমার সেই ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হতো, যাদের আমি বাইবেল অধ্যয়ন করিয়েছিলাম। প্রাক্তন ছাত্ররা যখন আমার সঙ্গে আমার “নাতিনাতনীদের”—তারা অধ্যয়ন করিয়েছে এমন নতুন বাপ্তাইজিত ব্যক্তিদের—পরিচয় করিয়ে দিত, তখন আমার কেমন লাগত, তা একটু কল্পনা করে দেখুন!
একবার একটা সম্মেলনে একজন ভাই আমার কাছে এসে বলে, সে একটা পাপ স্বীকার করতে চায়। আমি তাকে চিনতে পারিনি আর তাই অনেক কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম। সে বলে, “সান্তা অ্যানায় যে-যুবকরা আপনাদের দিকে পাথর ছুড়ে মেরেছিল, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।” আর এখন সে আমার সঙ্গে যিহোবার সেবা করছে! আমার হৃদয় তখন আনন্দে ভরে গিয়েছিল। এই কথাবার্তা থেকে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম, পূর্ণসময়ের পরিচর্যা হচ্ছে বেছে নেওয়ার মতো সবচেয়ে পুরস্কারদায়ক কেরিয়ার।
পরিতৃপ্তিদায়ক বিভিন্ন বাছাই
প্রায় ২৯ বছর ধরে আমি এল সালভাদরে মিশনারি সেবা করেছি। প্রথমে সান্তা অ্যানায়, এরপর সনসোনাতে, তারপর সান্তা তেকলায় আর সব শেষে সান সালভাদরে। ১৯৭৫ সালে, প্রার্থনাপূর্বক অনেক চিন্তাভাবনা করার পর, আমি মিশনারি সেবা ছেড়ে দিয়ে স্পোকানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তখন আমার বিশ্বস্ত এবং বয়স্ক বাবা-মায়ের সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল।
১৯৭৯ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর, আমি মায়ের দেখাশোনা করেছিলাম, যিনি দিন দিন আরও দুর্বল ও অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন। তিনি আরও আট বছর বেঁচে ছিলেন এবং ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সেই কঠিন সময়ে আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এসব চাপের কারণে আমার যন্ত্রণাদায়ক ফুসকুড়িযুক্ত এক প্রকার চর্মরোগ হয়। কিন্তু, প্রার্থনা এবং যিহোবার প্রেমময় বাহু আমাকে ধরে রেখেছিল আর আমি ধৈর্যের সেই পরীক্ষা সহ্য করতে পেরেছিলাম। এটা ঠিক সেইরকম, যেমনটা যিহোবা বলেছিলেন: “পক্বকেশ হওয়া পর্য্যন্ত . . . আমিই তুলিয়া বহন করিব, রক্ষা করিব।”—যিশা. ৪৬:৪.
১৯৯০ সালে, আমি ওয়াশিংটনের ওমাকে চলে এসেছি। এখানে স্প্যানিশভাষী ক্ষেত্রে এসে আমার মনে হয়েছে, আমি আবারও কাজ করতে পারি আর এখানে আমার বেশ কয়েক জন বাইবেল ছাত্র বাপ্তিস্ম নিয়েছে। ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসের পর, আমার পক্ষে আর ওমাকে থেকে আমার বাড়িঘরের যত্ন নেওয়া সম্ভব ছিল না আর তাই আমি ওয়াশিংটনের কাছাকাছি শেলান শহরে একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে শুরু করি। তখন থেকে এখানকার স্প্যানিশ মণ্ডলী উত্তমভাবে আমার যত্ন নিচ্ছে আর এর জন্য আমি অনেক কৃতজ্ঞ। যেহেতু এখানে আমিই একমাত্র বয়স্ক সাক্ষি, তাই ভাই ও বোনেরা সদয়ভাবে আমাকে তাদের “দিদা” হিসেবে “গ্রহণ” করে নিয়েছে।
আমি বিক্ষেপ ছাড়াই আরও পূর্ণরূপে পরিচর্যা করার জন্য বিয়ে করিনি এবং পরিবার গড়ে তুলিনি। (১ করি. ৭:৩৪, ৩৫) কিন্তু, আমার অনেক আধ্যাত্মিক সন্তান রয়েছে। আমি যুক্তি করেছিলাম, বর্তমান জীবনে আমি সমস্ত কিছু লাভ করতে পারব না। তাই, আমি আমার জীবনের প্রথম বিষয়টাকে প্রথমে রেখেছিলাম অর্থাৎ যিহোবাকে পূর্ণহৃদয়ে সেবা করার ব্যাপারে আমার উৎসর্গীকরণকে আমার জীবনে প্রথমে রেখেছিলাম। নতুন জগতে সমস্ত ধরনের গঠনমূলক কাজ উপভোগ করার জন্য প্রচুর সময় থাকবে। আমার প্রিয় শাস্ত্রপদ হল গীতসংহিতা ১৪৫:১৬ পদ, যেখানে এই আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, যিহোবা “সমুদয় প্রাণীর বাঞ্ছা পূর্ণ” করবেন।
৯১ বছর বয়সেও আমার স্বাস্থ্য বেশ ভালো আছে আর তাই আমি অগ্রগামীর কাজ করে যেতে পারছি। অগ্রগামী সেবার কারণে আমি এখনও নিজেকে মনে মনে একজন তরুণী বলেই মনে করি আর এই কাজ আমাকে জীবনের এক উদ্দেশ্য প্রদান করেছে। আমি যখন প্রথম এল সালভাদরে আসি, তখন প্রচার কাজ মাত্র শুরু হতে যাচ্ছিল। শয়তানের ঘোর বিরোধিতা সত্ত্বেও, এই দেশে এখন ৩৯,০০০-রেরও বেশি প্রকাশক রয়েছে। এটা সত্যিই আমার বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছে। নিঃসন্দেহে, যিহোবার পবিত্র আত্মা তাঁর লোকেদের প্রচেষ্টায় সাহায্য করছে!